নানা নামের কলকাতা ( পর্ব -৩)
শ্যামবাজার, বাগবাজার ছেড়ে আরেকদিকে কুমোরটুলি, হাটখোলা পেরিয়ে আস্তে আস্তে এবার রওনা দেওয়া গেল কলকাতার উত্তর-পূর্ব দিকে রাজকীয় বিলাসে ছড়িয়ে থাকা শোভাবাজারের উদ্দেশ্যে। উত্তর কলকাতার অন্যতম রাজকীয় স্থান এই শোভাবাজার। যেখানে আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাবেকি গন্ধ। হাতিবাগানের গ্রে স্ট্রিট এবং রবীন্দ্র সরণীর মাঝে নবকৃষ্ণ দেব স্ট্রিট ধরে হেঁটে গেলেই পাওয়া যাবে শোভাবাজার। যেখানে রয়েছে নবকৃষ্ণ দেবের প্রতিষ্ঠা করা বিখ্যাত রাজবাড়ী শোভাবাজার রাজবাড়ী। ১৯৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভের উদ্যোগে কলকাতার প্রথম শোভাবাজার রাজবাড়ীতে এই দুর্গাপুজাটি স্থাপিত হয়েছিল। তার পাশেই রয়েছে কালী কৃষ্ণদেবের রাজবাড়ি। তবে কলকাতার এই দুই রাজবাড়ীই রয়েছে শোভা বাজারে। স্বাভাবিকভাবেই বনেদিয়ানা আর শোভা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে তারা শোভাবাজারের। কিন্তু এই শোভাবাজারের 'শোভা' কে? সেই নিয়ে রয়েছে একাধিক বিড়ম্বনা। কেউ কেউ বলেন নবকৃষ্ণ দেব নাকি ছিনিয়ে নিয়েছেন শোভাবাজারের আসল মালিকের পরিচয়।
আসলে এই শোভাবাজারের আড়ালে যে শোভা রয়েছে তিনি আর কেউ নন শোভারাম বসাক। ১৯৬০ সালে জব চার্নক যখন কলকাতায় এসে ভিড় জমিয়েছিলেন তখন কলকাতা নগরের পত্তনের জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। ভেবেছিলেন এখানেই বসাবেন তাঁর পরিকল্পিত শহর উলুবেড়িয়া। যদিও পরবর্তীকালে সে পরিকল্পনাটি বাতিল হয়। তারপর সেখানে জন্ম নেয় কলকাতা, সুতানটি এবং গোবিন্দপুর। তখন যদিও এই শোভা বাজার নামের কোন অস্তিত্ব ছিলনা বরং তার পরিবর্তে এই অঞ্চলের নাম ছিল 'পাবনা বাসনা'। যাকে বলে একেবারে বেহদ্দ্য গ্রাম।
যদিও শহর গড়ে ওঠার কিছুদিনের মধ্যেই হুগলির আদিসপ্তগ্রামের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রতিপত্তি বাড়তে লাগলো এখানে। সেখানকার বসু এবং শেঠরা সুতানুটির হাটে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসতে থাকেন। তখনই বসাক বংশের এক বিখ্যাত পুরুষ শোভারাম বসাক এই কলকাতায় আসেন। এবং এই অঞ্চলে তার বিখ্যাত সুতোর ব্যবসা চালু করেন। ইংরেজদের শাসকদের মধ্যেও খ্যাতি ছিল তার। সবাই একটু সমঝেই চলতেন তাকে। সেই সময় ইংরেজরা চেয়েছিলেন তাকে সিরাজউদ্দৌলার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে জয় লাভ করতে। কিন্তু তিনি কোনভাবেই এতে রাজি হননি। যে কারণে ব্রিটিশদের বিরাটভাজন হতে হয়েছিল তাকে। তবে এই শোভা বাজারের নামকরণ যে তার নাম থেকেই এসেছে সে কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। কারণ তার নাম শোভা আর তার সুতোর বাজার ছিল এই অঞ্চলেই। তাই তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে হয় শোভাবাজার। এক্ষেত্রে আবার অনেকে বলেন 'শোভারাম বাজার' কেন হলো না। যদিও তার সঠিক উত্তর নেই।
উল্টোদিকে আবার ব্রিটিশদের মুনশি ছিলেন নবকৃষ্ণ দেব। তাদের কাছ থেকেই 'রাজা' উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। তবে এই উপাধির পরিবর্তে ব্রিটিশদের খিদমত খাটতে হতো তাকে। আর সেই থেকেই হয় তার প্রতিপত্তি। শোনা যায় এই শোভা বাজার আগে ছিল 'সভাবাজার'। আর সেই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজা নবকৃষ্ণ দেব। সুকুমার সেন হরিসাধন মুখোপাধ্যায় পণ্ডিতরা মনে করেন নবকৃষ্ণই জড়িয়ে রয়েছে এই শোভাবাজার নামের সঙ্গে। আসলে নবকৃষ্ণের মাতৃবিয়োগের পর তিনি জাঁকজমক করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিলেন। রাজা মন্ত্রী জমিদার সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভোজ সভার। সেই সভা থেকেই পরবর্তীকালে শোভাবাজার হয়ে যায়। যদিও স্থানীয়রা শোভারাম বসাককে এগিয়ে রেখেছেন শোভাবাজার নামের ইতিহাসের সঙ্গে। তবে ইতিহাস যাই হোক না কেন শোভাবাজার কিন্তু আজও বাঙালি তথা ইতিহাস প্রেমীদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। এখানে প্রত্যেকটি গলিতে ছড়িয়ে রয়েছে বনেদিয়ানার স্মৃতি। রয়েছে রাজকীয় মেজাজ। আর এই মেজাজটাই বোধহয় শোভাবাজারের আসল 'শোভা'।
কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল এবং তাদের নামের ইতিহাসের যাত্রাপথ কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আমরা আরো বিভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরবো আপনাদের কাছে। তবে সেই জন্য আপনাদের থাকতে হবে আমাদের সঙ্গে। সাবস্ক্রাইব করতে হবে আমাদের চ্যানেল Bengal Fusion News Time -কে।